ভগবান শিব -শিবের বিভিন্ন রূপ ও বৈশিষ্ট্য,-শিবরাত্রি এবং মহাশিবরাত্রি।
শিব: ধ্বংস ও মঙ্গলের দেবতা
শিব শব্দের আক্ষরিক অর্থ “শুভ” বা “মঙ্গল”। তিনি হিন্দু ত্রিমূর্তির অন্যতম দেবতা ও ধ্বংসের প্রতীক। শিবের বিভিন্ন নামের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মহেশ্বর, শঙ্কর, ভোলানাথ, নীলকণ্ঠ, রুদ্র এবং মহাদেব। শিবের বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে রয়েছে তৃতীয় নয়ন, গলায় বাসুকী নাগ, জটার উপর থেকে প্রবাহিত গঙ্গা, তাঁর অস্ত্র ত্রিশূল এবং বাদ্যযন্ত্র ডমরু। শিবের মন্ত্র হলো: ওঁ নমঃ শিবায়।
শিবের বিভিন্ন রূপ ও বৈশিষ্ট্য
১. অর্ধচন্দ্র ও তৃতীয় নয়ন:
শিবের মস্তকে একটি অর্ধচন্দ্র বিরাজমান, যা তাঁকে "চন্দ্রশেখর" নামে অভিহিত করে। তাঁর কপালে তৃতীয় নয়নের উপস্থিতির কারণে তিনি "ত্রিলোচন" নামে পরিচিত।
২. জটাজুট ও নীলকণ্ঠ:
শিবের চুল জটাবদ্ধ, তাই তাঁকে "জটাধারী" বলা হয়। সমুদ্র মন্থনের সময় হলাহল বিষ পান করার পর তাঁর কণ্ঠ নীল হয়ে যায়, যার ফলে তিনি "নীলকণ্ঠ" নামে খ্যাত হন।
৩. গঙ্গাধর ও কৃত্তিবাস:
শিব জটায় গঙ্গাকে ধারণ করেন, তাই তাঁর আরেক নাম "গঙ্গাধর"। শিবের পোশাক ব্যাঘ্রচর্ম হওয়ায় তিনি "কৃত্তিবাস" নামে পরিচিত।
৪. সর্প ও অস্ত্র:
শিবের গলায় বাসুকী নামে একটি সর্প শোভা পায়। তাঁর অস্ত্র ত্রিশূল ও বাদ্যযন্ত্র ডমরু।
৫. নন্দী ও পশুপতি:
নন্দী নামের পৌরাণিক ষাঁড় শিবের বাহন। পশুদের দেবতা হিসেবে তাঁকে "পশুপতি" বলা হয়।
৬. ভূতগণ ও গণপতি:
শিবের অনুচরদের "গণ" বা "ভূতগণ" বলা হয়। শিব তাঁর পুত্র গণেশকে গণের নেতা নিযুক্ত করেন, তাই গণেশ "গণপতি" নামে পরিচিত।
শিবের বাসস্থান ও প্রিয় স্থান
কৈলাস: শিবের অধিষ্ঠান কৈলাস পর্বতে।
বারাণসী (কাশী): বারাণসী তাঁর প্রিয় তীর্থস্থান। এটি কাশীধাম নামেও পরিচিত।
শিবের রূপ
শিবের দুই ভয়ংকর রূপ হলো "কাল" ও "মহাকাল", যা ধ্বংসের প্রতীক। "ভৈরব" রূপে তিনি ভয়ংকর, আর "শঙ্কর" রূপে তিনি মঙ্গলময়। যোগশাস্ত্রের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কারণে তাঁকে "মহাযোগী" বলা হয়। গৃহী রূপে তিনি পার্বতীর স্বামী এবং গণেশ ও কার্তিকেয়ের পিতা। পার্বতীকে "উমা" বলেও ডাকা হয়, তাই শিবের নাম হয় "উমাপতি"।
পুত্রগণ:
কার্তিকেয়: দক্ষিণ ভারতে সুব্রহ্মণ্যন ও মুরুগান নামে পূজিত।
গণেশ: হিন্দু সমাজে বিশেষভাবে পূজিত।
শিবের অন্যান্য বিশেষ রূপ
১. মৃত্যুঞ্জয়:
শিবকে মৃত্যুঞ্জয় বলা হয়, কারণ তিনি মৃত্যুর দেবতা যমকে পরাজিত করেছিলেন। ঋষি মার্কণ্ডেয় শিবের আরাধনা করলে শিব তাঁকে যমরাজের হাত থেকে রক্ষা করেন।
২. অর্ধনারীশ্বর:
অর্ধনারীশ্বর রূপে শিবের অর্ধেক দেহ পুরুষ ও অর্ধেক নারী।
৩. ত্রিপুরান্তক:
ত্রিপুরাসুরের তিন দুর্গ ধ্বংস করায় তিনি "ত্রিপুরান্তক" নামে পরিচিত।
৪. অষ্টমূর্তি:
শিবের আটটি রূপকে একত্রে অষ্টমূর্তি বলা হয়:
ভব (অস্তিত্ব)
শর্ভ (ধনুর্ধর)
রুদ্র (দুঃখদাতা)
পশুপতি (পশুপালক)
উগ্র (ভয়ংকর)
মহান (সর্বোচ্চ আত্মা)
ভীম (মহাশক্তিধর)
ঈশান (মহাবিশ্বের দিকপতি)
৫. শিবলিঙ্গ:
শিবলিঙ্গ সর্বমঙ্গলময় প্রতীকের প্রতিরূপ।
মহাশিবরাত্রি
শিব ও মাতা পার্বতীর বিবাহ মহাশিবরাত্রিতে সম্পন্ন হয়েছিল। এই দিনে শিব সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের তাণ্ডব নৃত্য করেন।
শিবরাত্রি ও ব্যাধ কাহিনি:
এক ব্যাধ এক রাতে বেলগাছের ডালে বিশ্রাম নিতে গিয়ে ভুলক্রমে শিবলিঙ্গের উপর বেলপাতা ফেলেন। এই দিন ছিল শিবচতুর্দশী। উপবাস ও অজান্তে পুজোর কারণে ব্যাধ পরকালীন পুণ্যলাভ করেন। যমদূতদের পরাজিত করে শিবদূতেরা তাঁকে কৈলাসে নিয়ে যান।
শিব ব্রতের মাহাত্ম্য
শিবচতুর্দশী পালনে মানুষের পাপমুক্তি ঘটে। মহাশিবরাত্রি ব্রত হিন্দু সমাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিবমহাপুরাণ অনুযায়ী, এই রাতে শিব জীবের পাপ মোচন ও মুক্তির পথ প্রদর্শন করেন।