পূজা কত প্রকার ? পূজা কিভাবে করবেন ? পূজার দ্বারা কিভাবে ফল লাভ করবেন ?

ঈশ্বরের পূজায় ঈশ্বর উপকৃত হন না।
 ঈশ্বরের পূজায় ভক্ত উপকৃত হন।

পূজার সংজ্ঞা:
ভগবানের গুণাবলি প্রকাশক এবং গুণারোপিত ভগবৎ সত্তার পরিচায়ক দেবগণের প্রীতির জন্য সঠিক সেবা, গুণকীর্তন, প্রার্থনা, প্রণাম ও শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করার আনুষ্ঠানিকতাকে পূজা বলা হয়। এক কথায়, সেবক ও ইশ্বরের ঐক্য সম্পর্কই পূজা। পূজার মূল উপাদান হলো ভক্তি। ভক্তি ছাড়া পূজা নিস্ফল হয়। পূজা দুটি অঙ্গ বা ভাগে বিভক্ত—বাহ্য পূজা ও আভ্যন্তর পূজা।

ভক্তিনীতি:
বাহ্যা ভক্তির্দুরাচারঃ, অন্তর্ভক্তিঃ সদাচারঃ।
অন্তর্ভক্ত্যা আত্মশুদ্ধিঃ, আত্মশুদ্ধ্যা ঈশ্বরপ্রাপ্তিঃ॥


বাহ্য পূজা:
বাহ্য পূজা দুই প্রকার—বৈদিক পূজা ও তান্ত্রিক পূজা।

বৈদিক পূজা: বেদের নির্দেশ অনুযায়ী যে পূজা সম্পন্ন হয়, তাকে বৈদিক পূজা বলা হয়।
তান্ত্রিক পূজা: তন্ত্রের নিয়ম অনুসারে যে পূজা করা হয়, তাকে তান্ত্রিক পূজা বলা হয়।
আভ্যন্তর পূজা:
মনের গভীর ভক্তি দ্বারা যে পূজা সম্পন্ন হয়, সেটি আভ্যন্তর পূজা।


श्री जगन्नाथ भक्ति तत्व।
निष्कामकर्मदृष्ट्या प्रभुं प्रसन्नं भवदीय सः
निष्कामभक्तिभावेन मग्नः प्रभुं प्राप्नोति सः

स एव श्रीजगन्नाथः परब्रह्म सनातनः।
मोक्षमुक्तिप्रदाता स निर्गुणो निरञ्जनः॥ 

सर्वभूतेषु यो नित्यं स्थितोऽसौ परमात्मवान्।  
भवसागरपाराय स विश्वात्मा सनातनः॥  

भावग्राही स भगवान् भावैस्तुष्यति नित्यदा।  
भावमात्रेण सन्तुष्टो जगन्नाथो महाप्रभुः सदा॥

শ্রী জগন্নাথ ভক্তি তত্ত্ব।

নিষ্কামকর্মদৃষ্ট্যা প্রভুঁ প্রসন্নং ভবদীয় সঃ  
নিষ্কামভক্তিভাবেন মগ্নঃ প্রভুঁ প্রাপ্নোতি সঃ।

স এব শ্রীজগন্নাথঃ পরব্রহ্ম সনাতনঃ।  
মোক্ষমুক্তিপ্রদাতা স নির্গুণো নিরঞ্জনঃ॥

সর্বভূতেষু যো নিত্যং স্থিতোऽসৌ পরমাত্মবান্।  
ভবসাগরপারায় স বিশ্বাত্মা সনাতনঃ॥

ভাবগ্রাহী স ভগবান  ভাবৈস্তু্ষ্যতি নিত্যদা।  
ভাবমাত্রেণ সন্তুষ্টো জগন্নাথো মহাপ্রভুঃ সদা॥
💧


পূজার প্রকারভেদ:
পূজা সাধারণত দুই প্রকার—মূর্তি পূজা ও মানস পূজা।

মূর্তি পূজা: ভগবানের মূর্তি বা প্রতিকৃতি সামনে রেখে যে পূজা করা হয়, সেটি মূর্তি পূজা। প্রাচীন ঋষি-মুনিরা মানুষের চঞ্চল মনকে একাগ্র ও ভগবানের প্রতি আসক্ত করতে মূর্তি পূজার প্রচলন করেছিলেন।
মানস পূজা: ধ্যানে বা মনে ভগবানের যে পূজা করা হয়, সেটি মানস পূজা।
কর্মফল বা উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে পূজা:
উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে পূজা দুই প্রকার—কাম্য-কর্মাত্মক পূজা ও নিষ্কাম পূজা।

কাম্য-কর্মাত্মক পূজা: ব্যক্তিগত স্বার্থ সিদ্ধির লক্ষ্যে যেমন ধন, জন, বিদ্যা, বুদ্ধি, রোগমুক্তি ইত্যাদির জন্য যে পূজা করা হয়, তা কাম্য-কর্মাত্মক পূজা।
নিষ্কাম পূজা: সমাজের কল্যাণ, উন্নয়ন ও বৃহৎ সমৃদ্ধির লক্ষ্যে মহৎ উদ্দেশ্যে যজ্ঞ ও সেবামূলক কর্মাদির মাধ্যমে যে পূজা করা হয়, সেটি নিষ্কাম পূজা।
এই দুই ধরনের পূজার মধ্যে নিষ্কাম পূজাই সর্বোত্তম।

উপাচার (উপকরণ) ভেদে পূজার প্রকারভেদ
উপাচার বা উপকরণের ভিত্তিতে পূজা চার প্রকার:

১. পঞ্চ উপাচারে পূজা:
পঞ্চ উপাচার অর্থাৎ পাঁচটি উপকরণ—চন্দনাদি সুগন্ধ দ্রব্য, জল, নৈবেদ্য, ধূপ-দীপ এবং ফুল—ব্যবহার করে যে পূজা করা হয়, তাকে পঞ্চ উপাচারে পূজা বলা হয়।
এই পাঁচটি উপকরণ যথাক্রমে ক্ষিতি (পৃথিবী), অপ (জল), তেজ (আগুন), মরুৎ (বায়ু), এবং ব্যোম (আকাশ) বা শরীর, মন, প্রাণ, অনুভূতি, ও অহংকারের প্রতীক। এছাড়াও এদের দ্বারা ভৌত, প্রাণময়, মনোময়, বোধময় ও আনন্দময় জীবনক্ষেত্রের প্রতীক নির্দেশ করা হয়।

২. বহু উপাচারে পূজা:
যখন পূজারী তার ইষ্ট দেবতার প্রীতির জন্য দশ, শত বা সহস্র উপকরণ ব্যবহার করেন, তখন তাকে বহু উপাচার পূজা বলা হয়। বারোয়ারী বা সার্বজনীন পূজা সাধারণত দশোপচার বা ষোড়শোপচারে করা হয়।

দশোপচার পূজা: দশটি উপকরণ ব্যবহার করে পূজা করা হয়। উপকরণগুলো হলো—পাদ্য, অর্ঘ্য, আচমনীয়, মধুপর্ক, পুনরাচমনীয়, গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ এবং নৈবেদ্য।
ষোড়শোপচার পূজা: ষোড়শ উপকরণ দ্বারা পূজার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়। মতান্তরে এই ষোড়শ উপাচার হলো—আসন, স্বাগত, পাদ্য, অর্ঘ্য, আচমনীয়, মধুপর্ক, পুনরাচমনীয়, স্নান, বসন, আভরণ, গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ, চন্দন ও নৈবেদ্য।
দেবতাদের পৈতা, উত্তরীয়, মালা, তাম্বূল (পান) এবং দেবীদের শাঁখা, সিন্দুর, আয়না, চিরুনি, কাজল, আলতা ইত্যাদি উপাচারও প্রদান করা হয়।
৩. স্বল্প উপাচারে পূজা:
অজানা বা অচেনা স্থানে পূজা করার সময় যদি শ্রম ও চেষ্টা সত্ত্বেও পঞ্চ উপাচার সংগ্রহ করা না যায়, তখন স্বল্প উপাচারে পূজা সম্পন্ন করা হয়।

৪. মানস পূজা বা উপাচারহীন পূজা:
যে সমস্ত ব্যক্তি ভগবানের স্বরূপ অনুধাবন করেছেন, তারা ধ্যানে ও মনে ভগবানের পূজা করেন। এই পূজাকে মানস পূজা বা উপচারহীন পূজা বলা হয়।

পূজার মানসিকতার ভিত্তিতে প্রকারভেদ:
১. ব্যক্তিগত পূজা:
যখন ব্যক্তি নিজেই পূজা করেন, তখন তাকে ব্যক্তিগত পূজা বলা হয়। এ পূজার মুখ্য বিষয় হলো ব্যক্তিগত সাধনা।

২. সমষ্টিগত পূজা:
পুরোহিতের পরিচালনায় একাধিক লোক কর্তৃক সমবেতভাবে পূজা করা হলে তাকে সমষ্টিগত পূজা বলা হয়। এই ধরনের পূজা সাধারণত পঞ্চ উপচার বা বহু উপচারে সম্পন্ন হয়।

সর্বোত্তম পূজা:
যখন ভগবানকে নৈবেদ্য হিসেবে ফল এবং ভক্তি হিসেবে চোখের জল অর্পণ করা হয়, তখন সেই পূজাই শ্রেষ্ঠ পূজা হিসেবে বিবেচিত হয়।

পূজায় ধূপের ব্যবহার
প্রাচীন কাল থেকেই আমাদের দেশে ঘরে ধূপ ও ধুনো জ্বালানোর প্রথা প্রচলিত। প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে, ধূপকাঠি জ্বালানো বাড়িতে ইতিবাচক পরিবেশ বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং পরিবারের সকল সদস্যের জীবনে শান্তি ও সৌহার্দ্য তৈরি করে।
হিন্দুধর্মে বলা হয়, বাঁশ কাঠি জ্বালালে অমঙ্গল হতে পারে। তাই পূজায় বাঁশ কাঠি দিয়ে তৈরি ধূপ ব্যবহার না করে বাঁশকাঠি বর্জিত ধূপ বা ধুনো ব্যবহার করা উচিত।

পূজা ও পূজার ফল
উপাসক বা পূজকের অধিকার আছে পূজা করার, তবে পূজার ফল পাওয়ার অধিকার নেই। পূজার ফল ভগবানের করুণা ও দয়ার উপর নির্ভরশীল। ভগবান প্রসন্ন হলে তবেই পূজার ফল লাভ হয়।
অনেক পূজক ভুলবশত মনে করেন পূজার ফল পাওয়া তাঁদের অধিকার। ফল না পেলে ভগবানের পূজা করা বন্ধ করে দেন বা তাঁর প্রতি অবমাননাকর মনোভাব পোষণ করেন। এটি সঠিক নয়। পূজার ফল ভগবানের হাতে এবং তা নীতি, নিয়ম ও বিধির বাঁধনে বাঁধা।

পূজায় ফল না পাওয়ার কারণ
১. পূজার বিধি না মেনে বা পূজায় শ্রদ্ধার অভাব থাকা।
২. ভগবানের দ্বারা পূজা গ্রহণ না করা।

ভগবানের পূজা গ্রহণ না করার প্রধান কারণগুলো হলো:
১. পূজকের মাছ, মাংস, মদ ইত্যাদি ভক্ষণ।
২. জীব হত্যা বা হত্যায় সাহায্য করা।
৩. ভগবানের প্রতি পূজকের মনোযোগ, প্রেম, শ্রদ্ধা ও ভক্তির অভাব।

উপরোক্ত কার্যকলাপে ভগবান রুষ্ট হন। জীবদের হত্যা করার ফলে আমরা প্রভুর সন্তানদের অভিশাপ পাই এবং ঘৃণার পাত্র হয়ে উঠি।

পূজায় ফল লাভের উপায়
১. মাছ, মাংস, মদ ইত্যাদি খাওয়া বন্ধ করতে হবে এবং সাত্ত্বিক মনোভাব গড়ে তুলতে হবে।
২. জীব হত্যা ও এতে সহযোগিতা করা বন্ধ করতে হবে।
৩. কাম, ক্রোধ, লোভ দূরে রেখে ভগবানের প্রতি যথাযথ প্রেম, শ্রদ্ধা ও ভক্তি রেখে পূজা করতে হবে।
৪. পূজা বিধি মেনে পূজা করতে হবে।

ধৈর্য, ক্ষমা, সংযম, চুরি না করা, দেহ ও মনের পবিত্রতা, শাস্ত্রজ্ঞান, সত্য আচরণ ও ক্রোধ বর্জন করতে হবে।

পূজার মন্ত্র ও উচ্চারণের গুরুত্ব
পূজার মন্ত্রের সঠিক উচ্চারণ ও অর্থ অনুধাবন একান্ত প্রয়োজন। মন্ত্রের অর্থ বুঝলে পূজক জানবেন তিনি দেবতার কাছে কী প্রার্থনা করছেন এবং মন্ত্রের গভীরতা উপলব্ধি করতে পারবেন।
যিনি অর্থসহকারে মন্ত্রপাঠ করেন, তিনি সম্পূর্ণ ফল লাভ করেন। শাস্ত্রের নির্দেশ অনুযায়ী, "দেবো ভূত্বা দেবং যজেৎ" অর্থাৎ নিজেকে দেবস্বরূপ ভাবতে ভাবতে দেবতা হয়ে দেবতার পূজা করতে হয়। "যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী" অর্থাৎ যার ভাবনা যেমন, তার সফলতাও তেমন।

পূজার সম্পূর্ণতা ও ভগবানের আরতি
পূজা একটি সাধনা এবং আরাধনা। এটি ঈপ্সিত বস্তু লাভের জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা। বাহ্যিক ও অন্তরের পূজা একে অন্যের পরিপূরক। ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সাথে নিখুঁত পূজা করাই প্রকৃত পূজার সার্থকতা।
গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, "ভক্তিপূর্বক যে আমাকে পত্র, পুষ্প, ফল ও জল অর্পণ করে, আমি তার সেই ভক্তি-উপহার প্রীতির সঙ্গে গ্রহণ করি।" পূজায় যদি ত্রুটি থাকে তবে ভগবানের আরতি করলে তা পূর্ণতা লাভ করে।

যদি আরতি সম্পর্কে জানা না থাকে, তবে ভগবান নারায়ণের আরতি করুন, কারণ সমস্ত পূজা শেষ পর্যন্ত নারায়ণের কাছেই পৌঁছে। তিনি ত্রিগুণাতীত, অর্থাৎ সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণের ঊর্ধ্বে। তিনিই পরমাত্মা ও পরমব্রহ্ম।

যারা সত্যিই পূজার পদ্ধতি জানতে আগ্রহী, তাদের উচিত:শ্রীমদ্ ভাগবতমের, ১১তম স্কন্ধের ২৭ নম্বর অধ্যায় টি  পড়া। এই অধ্যায়টি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে যে একজন ব্যক্তির কীভাবে বিশ্বাস, পরিচ্ছন্নতা এবং ভক্তির সঙ্গে ভগবানের মূর্তির পূজা করা উচিত। এতে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা, স্নান, মন্ত্রপাঠ, জল, ফুল, খাদ্য এবং পবিত্র সামগ্রীর নিবেদন প্রক্রিয়া এবং শুধুমাত্র বাহ্যিক ঐশ্বর্য থেকে উপরে সৎ ভক্তির গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে।


ভক্ত-দেব–অসুর–মানব–স্বভাব–বিবেচনम् 

কার্যকালে নমস্কারঃ, কাৰ্যে সমাপ্তে তিরস্কারঃ।
স্বার্থে তু দেবতাজ্ঞানम्, অস্বার্থে তু অবজ্ঞানम्॥

অর্থদাতে স্নেহঃ অনুরাগঃ, অর্থহীনে নিঃশব্দত্যাগঃ।
এবমেব মানবস্য স্বভাবঃ, গুরুকৃপয়া প্রস্ফুরতি সুভাবঃ॥

সুরাসুর এতদ্ দ্বয়ং স্বভাবতঃ প্রায়ঃ সমানভাবম্।
ভক্তস্তয়োর্মধ্য শ্রেয়ঃ, নিষ্কামকর্মধর্মং করোতি ধ্রুবম্॥

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ভগবান (ঈশ্বরঃ) - ঈশ্বর প্রাপ্তির লক্ষণ।

বিপত্তারিণী পূজার নিয়ম - विपत्तारिणी की पूजा के नियम-How to perform Bipadtarini puja.