শান্তি পূজা ও তার বৈদিক মন্ত্র।



 শান্তির প্রকার।

সাধারণ ভাবে শান্তি দুই প্রকার 

১.দৈহিক শান্তি। শরীরের /দেহের শান্তি কে দৈহিক শান্তি বলা হয়। 

 ২ মানসিক শান্তি। মনের শান্তি কে মানসিক শান্তি বলা হয়। মানসিক/মনস্তাত্ত্বিক শান্তি" যেমন শান্তিপূর্ণ চিন্তাভাবনা এবং আবেগ ইত্যাদি। 

এই দৈহিক শান্তি ও মানসিক শান্তি যার কারণে বিঘ্নিত হয় তাকে বলা হয় বিঘ্ন

 হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে, বিঘ্ন তিন প্রকার। 

1.আধ্যাত্মিক বিঘ্ন: আত্মা হইতে আগত বিঘ্ন ; ধর্ম বিষয়ক, ব্রহ্ম বিষয়ক বিঘ্ন। শারীরিক ব্যাধি, মানসিক অস্থিরতা, অঙ্গহানি ইত্যাদি।

2.আধিভৌতিক বিঘ্ন:  অধিভূত অর্থাত ভৌতিক পদার্থ এবং জীবজন্তুদের কারণে বা তাদের দ্বারা উত্পন্ন বিঘ্ন ।যেমন সাপে কামড়ানো, বাঘে ধরা ইত্যাদি।

3.আধিদৈবিক বিঘ্ন: দৈব বা প্রাকৃতিক ঝড়-বন্যা ইত্যাদি যা মানুষের নিয়ন্ত্রণে নেই তার কারনে যে বিঘ্ন।যেমন প্লাবন, রোগ,মহামারী, খরা ইত্যাদি।

এই তিনরকম বিঘ্ন নাশ করতে হিন্দুধর্মের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান ও ক্রিয়াকর্মাদিতে শান্তিমন্ত্র পাঠ করা হয় এবং শেষে তিনবার ওঁ শান্তিঃ, ওঁ শান্তিঃ ,ওঁ শান্তিঃ বলা হয়।

শান্তি পূজা;-

 ব্যক্তি ,বস্তু ,বাস্তু, ঘর ,পরিবার ,দেশ ,প্রদেশ,আকাশ,বাতাস ,বনস্পতি ,অন্তরীক্ষ  ইত্যাদির   শান্তির জন্য যে পূজা করা হয় তাকে শান্তি পূজা বলা হয়।

শান্তি মন্ত্র পাঠ;-

 সাধারণত পূজা , আচার-অনুষ্ঠান এবং ধার্মিক  প্রবচনের  শেষে শান্তি মন্ত্র পাঠ করা হয়সনাতন হিন্দু ধর্মের বিভিন্য সম্প্রদায় বিভিন্য বেদ  ও,উপনিষদ  কে অনুসরণ করেন ,বেদ ও তাঁর উপনিষদ গুলিতে বিভিন্য  শান্তি মন্ত্রের উল্লেখ আছে ,সেগুলি হলো নিম্ন রূপ। 

বিঘ্ন নাশ /দুর  করার এবং শান্তি  স্থাপন করার(আনার )জনপ্রিয় বৈদিক মন্ত্র গুলি নিম্ন রূপ।  আমাদের সনাতন হিন্দুধর্মের  ১১টি মুখ্য উপনিষদে বর্ণিত শান্তি মন্ত্র গুলি শুনুন। 


শান্তি মন্ত্র পাঠ:- সাধারণত পূজা , আচার-অনুষ্ঠান এবং ধার্মিক  প্রবচনের  শেষে  এই শান্তি মন্ত্র পাঠ  করা হয়।

 1.নিম্ন লিখিত মন্ত্র টি যজুর্বেদ থেকে নেওয়া হয়েছে। 



বাংলাঃ- 

ওঁ দ্যৌ শান্তি অন্তরীক্ষ  শান্তি ,

পৃথিবী শান্তিরাপঃ শান্তিরোষধয়ঃ শান্তি।

বনস্পতয়ঃ শান্তিরবিশ্বেদেবা: শান্তিব্রহ্ম শান্তিঃ,

সর্ব শান্তিঃ শান্তিরেব  শান্তিঃ সা মা শান্তিরেধি ॥

ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।


সংস্কৃত;-

ॐ द्यौ: शान्तिरन्तरिक्षं शान्ति:

पृथिवी शान्तिराप: शान्तिरोषधय: शान्ति:।

वनस्पतय: शान्ति र्विश्वेदेवा: शान्ति र्ब्रह्म शान्ति:

सर्वं शान्ति:, शान्तिरेव शान्ति: सा मा शान्तिरेधि ॥

ॐ शान्ति: शान्ति: शान्ति: ॥

 

2.নিম্নলিখিত মন্ত্র টি শুক্ল যজুর্বেদের বৃহদারণ্যক উপনিষদ /ঈশোপনিষদ্‌ থেকে নেওয়া হয়েছে। 


ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে।

পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।।

 ওঁ শান্তিঃ, ওঁ শান্তিঃ, ওঁ শান্তিঃ।।

অর্থ: পরব্রহ্ম পূর্ণ, নামরূপ ব্রহ্মও পূর্ণ ;পূর্ণ থেকে পূর্ণ উদ্গত হন; পূর্ণের পূর্ণত্ব বিদ্যা সহায়ে গ্রহণ করলে পূর্ণই (পরব্রহ্মই) অবশিষ্ট থাকেন। ওঁ আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক - এই ত্রিবিধ বিঘ্নের বিনাশ হোক।

3.নিম্ন লিখিত মন্ত্র টি ঋগ্বেদের  ঐতরেয় উপনিষদ থেকে নেওয়া হয়েছে


ওঁ বাঙ্মে মনসি প্রতিষ্ঠাতা

মনো মে বাচি প্রতিষ্ঠিতম্, আবিরাবীর্ম এধি।

বেদস্য ম আণীস্থঃ, শ্রুতং মে মা প্রহাসীঃ, অনেনধীতেন অহোরাত্রান্সংদধামি

 ঋতং বদিষ্যামি, সত্যং বদিষ্যামি, তৎ মাম্ বতু

তৎবক্তারম্ বতু, অবতু মাম্, অবতু বক্তারম্ বতু বক্তারম্।

ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ।।

সংস্কৃত;-

ॐ वाङ् मे मनसि प्रतिष्ठिता। मनो मे वाचि प्रतिष्ठितम्।

आविराविर्म एधि। वेदस्य म आणीस्थः।

श्रुतं मे मा प्रहासीः अनेनाधीतेनाहोरात्रान्सन्दधामि।

ऋतं वदिष्यामि। सत्यं वदिष्यामि।

तन्मामवतु। तद्वक्तारमवतु।

अवतु माम्। अवतु वक्तारामवतु वक्तारम्॥

ॐ शान्तिः शान्तिः शान्तिः॥

অর্থ: আমার বাক্য মনে প্রতিষ্ঠিত হোক, আমার মন বাক্যে প্রতিষ্ঠিত হোন। হে স্বপ্রকাশ ব্রহ্ম, (আপনি) আমার নিকট প্রকাশিত হোন। (হে বাক্য ও মন তোমরা) আমার নিকট বেদার্থ আনয়নে সমর্থ হও। শ্রুত বিষয় যেন আমাকে ত্যাগ না করে। এই অধ্যয়ন অবলম্বনে আমি দিনরাতকে সংযোজিত করব। আমি মানসিক সত্য বলব, বাচনিক সত্য বলব। ব্রহ্ম আমায় রক্ষা করুন, আচার্যকে রক্ষা করুন; আমায় রক্ষা করুন, আচার্যকে রক্ষা করুন। আচার্যকে রক্ষা করুন। ওঁ আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক - এই ত্রিবিধ বিঘ্নের বিনাশ হোক।

4.শিক্ষক (আচার্য) ও বিদ্যার্থীর শান্তির জন্য নিম্নলিখিত  কৃষ্ণ যজুর্বেদিক শাখার তৈত্তিরীয় উপনিষদের এই মন্ত্র টির পাঠ করা হয়। 

ওঁ সহনাববতু , সহনৌ ভুনক্তু , সহ বীর্যং করবাবহৈ।

 তেজস্বীনাবধীতমস্তু , মা বিদ্বিষাবহৈ ।।

 ওঁ শান্তিঃ , ওঁ শান্তিঃ , ওঁ শান্তিঃ।।

অর্থ: (পরমাত্মা) আমাদের উভয়কে (আচার্য ও বিদ্যার্থী) সমভাবে রক্ষা করুন এবং উভয়কে তুল্যভাবে বিদ্যাফল দান করুন; আমরা যেন সমভাবে বিদ্যাফল লাভের সামর্থ্য অর্জন করতে পারি; আমাদের উভয়েরই লব্ধবিদ্যা তেজস্বী হোক; আমরা যেন পরস্পরকে বিদ্বেষ না করি। ওঁ আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক - এই ত্রিবিধ বিঘ্নের বিনাশ হোক। 

5.নিম্ন লিখিত মন্ত্র টি সামবেদের  কেনোপনিষদ্‌ ও ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌ থেকে নেওয়া হয়েছে। 

 ওঁ আপ্যায়ন্তু মমাঙ্গানি বাক্-প্রাণশ্চক্ষুঃ

শোত্রমথবলমিন্দ্রিয়ানি চ সর্বাণি।

সর্বং ব্রহ্মৌপনিষদং। মা অহং ব্রহ্ম

নিরাকুর্যাং, মা মা নিরাকরোৎ অনিরাকরণম্ অস্তু অনিরাকরণং মে অস্তু

তদাত্মনি নিরতে য উপনিষৎসু ধর্মাস্তে

ময়ি সন্তু তে ময়ি সন্তু।

ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ।।

 অর্থ: আমার অঙ্গসমূহ, বাক, প্রাণ, চক্ষু, কর্ণ ও বল এবং ইন্দ্রিয়সকল পুষ্টিলাভ করুক। সমস্ত পদার্থ স্বরূপতঃ উপনিষৎপ্রতিপাদ্য ব্রহ্মই। আমি যেন ব্রহ্মকে অস্বীকার না করি, ব্রহ্ম যেন আমাকে প্রত্যাখ্যান না করেন; তার সঙ্গে আমার এবং আমার সঙ্গে তার সম্পর্ক নিত্যসম্বন্ধযুক্ত হোক, অবিচ্ছেদ্য হোক, সেই পরমাত্মায় সততনিষ্ঠ আমার মধ্যে উপনিষদের বাক্যসমূহ মূর্ত হয়ে উঠুক। ওঁ আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক - এই ত্রিবিধ বিঘ্নের বিনাশ হোক।

6.নিম্ন লিখিত মন্ত্র টি সামবেদের  ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌ থেকে নেওয়া হয়েছে। 


ওঁ শং নো মিত্রঃ শং বরুণঃ। শং নো ভবত্বর্যমা।

শং নো ইন্দ্রো বৃহস্পতিঃ।শং নো বিষ্ণুরুরুক্রমঃ।

নমো ব্রহ্মণে।নমোস্তে বায়ো। ত্বমেব প্রত্যক্ষং ব্রহ্মাসি।।

ত্বমেব প্রত্যক্ষং ব্রহ্ম বদিষ্যামি। ঋতং বদিষ্যামি।

সত্যং বদিষ্যামি। তন্মামবতু।তদ্বক্তারমবতু।

অবতু মাম। অবতু বক্তারম।

ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ।।

সংস্কৃত;-

ॐ शं नो मित्रः शं वरुणः। शं नो भवत्वर्यमा।

शं नो इन्द्रो बृहस्पतिः। शं नो विष्णुरुरुक्रमः।

नमो ब्रह्मणे। नमस्ते वायो। त्वमेव प्रत्यक्षं बह्मासि। 

त्वामेव प्रत्यक्षं ब्रह्म वदिष्यामि। ऋतं वदिष्यामि। 

सत्यं वदिष्यामि। तन्मामवतु। तद्वक्तारमवतु। 

अवतु माम। अवतु वक्तारम्।

ॐ शान्तिः। शान्तिः। शान्तिः।

অর্থ: ভক্তের প্রতি স্নেহশীল মিত্রদেব আমাদের প্রতি সুখদায়ক হোন, বরুণদেব সুখপ্রদ হোন, অর্যমা সুখদায়ক হোন, ইন্দ্র ও বৃহস্পতি আমাদের আনন্দ দান করুন, জগদ্ব্যাপক উরুক্রম বিষ্ণু আমাদের সুখ দান করুন। ব্রহ্মরূপী বায়ুকে নমস্কার।হে বায়ু, আপনিই প্রত্যক্ষ ব্রহ্ম, আপনাকে নমস্কার। আপনি ঋতস্বরূপ বলে আপনাকে ঋত বলব। আপনি সত্যস্বরূপ। হে সর্বাত্মা ব্রহ্ম, আপনি আমাকে রক্ষা করুন; ব্রহ্ম-বক্তাকে রক্ষা করুন। আমাকে রক্ষা করুন; ব্রহ্ম-বক্তাকে রক্ষা করুন। ওঁ আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক - এই ত্রিবিধ বিঘ্নের বিনাশ হোক।

7.নিম্নলিখিত মন্ত্র টি শুক্ল যজুর্বেদের বৃহদারণ্যক উপনিষদ থেকে নেওয়া হয়েছে।

 ওঁ অসতো মা সদ্গময়।

তমসো মা জ্যোতির্গময়।

মৃত্যোর্মামৃতং গময়। ( - বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ ১।৩।২৮)

ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।।

আবিরাবীর্ম এধি।। ( - ঐতরেয় উপনিষদ্‌, শান্তিপাঠ)

রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং,

তেন মাং পাহি নিত্যম্।

অর্থ: অসত্য থেকে আমাকে সত্যে নিয়ে যাও, অন্ধকার থেকে আমাকে জ্যোতিতে/আলোতে নিয়ে যাও, মৃত্যু থেকে আমাকে অমৃতে নিয়ে যাও। হে স্বপ্রকাশ, আমার নিকটে প্রকাশিত হও। রুদ্র, তোমার যে প্রসন্নমুখ তার দ্বারা আমাকে সর্বদাই রক্ষা করো।

8.নিম্নলিখিত মন্ত্র টি শুক্ল যজুর্বেদ (কান্ব শাখা) থেকে নেওয়া হয়েছে।




9.অত্যন্ত  জনপ্রিয় শান্তি মন্ত্র। গরুড়পুরাণ।

সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ

সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ।

সর্বে ভদ্রাণি পশ্যন্তু

মা কশ্চিৎ দুঃখভাগভবেৎ।

ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ

সংস্কৃত;

सर्वे भवन्तु सुखिनः सर्वे सन्तु निरामयाः।

सर्वे भद्राणि पश्यन्तु मा कश्चिद्दुःखभाग् भवेत्।।

ॐ शान्तिः। शान्तिः। शान्तिः।

1.Garuḍa Purāṇa (35.51),

2. Aśīrvacanam 2 of itihāsa samuccaya,

3. Mantrabhāṣya of Uvaṭa.

সবাই ভালো থাকুন ,সুস্থ থাকুন। সমগ্র মানব জাতি ও জীব জন্তুর  কল্যাণ হোক। শান্তির জয় হোক,সত্যের জয় হোক,মানবতার জয় হোক ,সনাতন ধর্মের জয়  হোক। 🙏

আমি এই লেখা টি আমার এক মাত্র ছেলে   ৺আকাশ মহান্তী র 
 আত্মার শান্তি র জন্য উৎসর্গ করিলাম। 




লেখক পরিচিতি:- প্রবীর মহান্তী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের  উৎকল ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।  প্রবীরের  বইগুলি Amazon.com. flipkart.com, abebooks.com এর মাধ্যমে বিক্রি হয়। গুগল ও অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিন থেকে সার্চ করে এখনো পর্যন্ত ১২লাখের বেশি লোক  প্রবীরের লেখা আর্টিকেল গুলি পড়েছেন। 

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বিপত্তারিণী পূজার নিয়ম - विपत्तारिणी की पूजा के नियम-How to perform Bipadtarini puja.

সংসার সাগর- Sea of Samsara.